Thursday, May 29, 2014

আসামে ১৯শে মে ১৯৬১ বাংলাভাষা আন্দলনের ইতিহাস


                        
১৯শে মে ১৯৬১ সময় ২-৩৫ মিনিট আসাম রাইফেলসের রাইফেল থেকে চলল ১৭ রাউনড গুলি। ৯ জন বাংলা ভাষা শহিদের রক্তে লাল হোল তারাপুর ষ্টেশন সংলগ্ন জনপথ। ১২ জন আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন পথে। ২ জন পরে হাসপাতালে প্রান ত্যাগ করলেন। কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস বুকে বুলেট নিয়ে ২৪ বছর বেঁচে রইলেন।

কি তাদের অন্যায়? কি ছেয়েছিলেন তারা? তাদের অন্যায় ছিল তারা আসাম রাজ্য সরকারের একমুখী ভাষা নীতির প্রতিবাদ করছিলেন। তারা ছেয়েছিলেন একমাত্র অসমিয়াকে সরকারি স্বীকৃত ভাষা করা চলবে না, বাংলা  ভাষাকেও সমানাধিকার দিতে হবে। প্রতিবাদ করেছিলেন যে এক তৃতীয়াংশের ভাষাকে দুই তৃতীয়াংশের ওপর চাপিয়ে দেয়া চলবে না।

অসমিয়া বিধানসভায় বাঙ্গালি বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাসের বিরোধিতা সত্তেও ২৪শে অক্টোবর ১৯৬০ একমাত্র অসমিয়াকে সরকারি স্বীকৃত ভাষা করার প্রস্তাব পাশ করা হয়। এইভাবে উগ্র জাতিসত্তার আক্রমন তিব্রতর হয়ে উঠল। শুরু হোল ‘বঙ্গাল খেদা’ আক্রমন।  বহু নিরীহ প্রান অকালে ঝরে গেলো, বহু মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হল।

শত সহস্র হিন্দু নরনারী যারা পূর্ব বঙ্গে মুসলমানের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে পার্শ্ববর্তী আসামের জঙ্গল পরিস্কার করে সামান্য ছাষবাস করে, ছোট ব্যাবসা করে অতি কষ্টে শরণার্থীর জীবন ধারন করছিলেন তারাই হলেন অসমিয়া শাসক গোষ্ঠীর আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু। তথাপি তারা নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি বিসর্জন দেননি।  তারা ছেয়েছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। ১০ই অক্টোবর ১৯৬০, যেদিন অসমের কংগ্রেসি মুখ্য মন্ত্রি বিমল প্রসাদ চালিহা গুয়াহাটি বিধানসভাতে সেই প্রস্তাব রাখলেন, প্রতিবাদের শুরু সেদিন থেকে।

সংখ্যাগুরু অন-অসমিয় জনগনের উপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেয়া আইন প্রত্যাহার করার লক্ষে বাঙালি অধ্যুষিত বরাক ভ্যালিতে ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬১তে গঠিত হোল স্বর্গীয় রথিন্দ্রনাথ সেনের নেতৃত্তে কাছার গন সংগ্রাম পরিষদ।  ১৪ই এপ্রিল ’৬১ তে সিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি পালিত হোল সংকল্প দিবস। ২৪শে এপ্রিল  সিলচর, করিমগঞ্জ সহ বরাক ভ্যালিতে শুরু হোল ২০০ মাইল ব্যাপি দীর্ঘ পদযাত্রা। উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার দাবিতে সমর্থন ও জনচেতনা বৃদ্ধি। মহতি পদযাত্রার ইতি হোল সিলচর টাউনে ২রা মে ‘৬১তে।

অহিংস শান্তিপূর্ণ গনতান্ত্রিক আন্দলন বাঙালি বিদ্বেষী অসমিয়া শাসক গোষ্ঠীকে কোন ভাবেই বিচলিত করেনি। বরাক উপত্যকায় কাছার গন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্তে ১৯শে মে ১৯৬১ সর্বাত্মক ধর্মঘট ছিল তার অনিবার্য পরিণতি।  কিন্তু ধর্মঘট ভাঙ্গার চক্রান্ত থেমে ছিল না। থেমে ছিল না বাংলা ভাষার আন্দোলনকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া। এতদ সত্তেও ভাষা আন্দলনের জন ভিত্তি ক্রমশঃ দৃঢ়তর হয়ে উঠছিল। কারন, পরিষদ দাবী তোলে যে বাংলা সহ অন্যান্য আদিবাসী ভাষা গুলিকেও সরকারি স্বীকৃতি দিতে হবে।

ক্রমশঃ কোনঠাসা সরকার এক ব্যাপক গন আন্দলন ভাঙতে ভারতীয় সেনা বাহিনিকে তলব করল। ১২ই মে ’৬১ এল অসম রাইফেলস, মাদ্রাস রেজিমেন্ট, সেন্ট্রাল রিসার্ভ পুলিশ। শুরু হোল রুট মার্চ, ব্যাপক ধরপাকড়। ভাষা আন্দলনের তিনজন প্রধান নেতৃত্বদানকারী নলিনিকান্ত দাস, রথিন্দ্রনাথ সেন এবং  যুব শক্তি পত্রিকার সম্পাদক বিধু ভূষণ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হোল। চলল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। চলল বেপরয়া পুলিশের লাঠি চার্জ।

১৯শে মে ’৬১ শুরু হোল সর্বাত্মক ধর্মঘট।  সকাল থেকে ঐ দিন সিলচর, করিম গঞ্জ, হাইলাকান্দিতে সরকারি অফিস, আদালত, রেল ষ্টেশন ইত্যাদি স্থানে চলল শান্তিপূর্ণ ধর্না আন্দলন। ঘোষণা হোল, সিলচর থেকে বিকেল ৪-০০ টার শেষ ট্রেন চোলে গেলে উঠে যাবে ধর্মঘট। ট্রেন ঠিক সময়ে ছেড়ে চোলে গেলো। কেউ আটকায়নি। ষ্টেশন থেকে ঐ ট্রেনের জন্য একজন যাত্রীও পাওয়া গেলো না, একটা টিকিটও বিক্রি হয় নি। এমনই জনসমর্থন। তথাপি আন্দোলনকারী জনগণকে শিক্ষা দিতে পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে গন হত্যা করতে হোল। পরের দিন ভাষা শহিদদের দেহ নিয়ে চলল মহা মিছিল। সেই মিছিলের উপরেও চলল লাঠি, গুলি। তবু সরকারের জয় হোল না। বাংলা ভাষার জয় হোল। অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করল।

                                                          ..............................